চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, নগরের মোট ১৬ থানার প্রতিটিতেই এই কমিটি কাজ করবে। এসব কমিটির সদস্যদের সাথে সমন্বয় করতে মহানগরীর অধীনেও থাকবে একটি কমিটি। আর পুরো নগরজুড়ে জনসচেতনতা বাড়াতে ও অপরাধ কমাতে এই কমিটির মোট ৭৮৪ জন সদস্য কাজ করবে।
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, নৈশটহল, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, অপরাধদমনে তথ্য দেওয়া-এমন নানা কাজ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে করবেন এই সদস্যরা।
সংস্থাটির সদর দপ্তরের তথ্যমতে, গত ৫ আগস্টের পর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের বদলে নতুন করে প্রতিটি থানায় নাগরিক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে আত্মপ্রকাশ করায় থানাভিত্তিক ‘নাগরিক কমিটি’র বদলে ‘সিটিজেন ফোরাম’ নামে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
‘সিটিজেনস্ ফোরাম’-এর কাজ কি?
জানা গেছে, মূলত ২০১৩ সালে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) অপারেশনের অধীনে স্বল্প পরিসরে শুরু করেছিল কমিউনিটি পুলিশিং। ২০১৪ সালে একজন সহকারী মহাপরিদর্শকের (এআইজি) তত্ত্বাবধানে পাবলিক সেফটি অ্যান্ড প্রিভেনশন (পিএস অ্যান্ড সিপি) শাখার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর কমিউনিটি পুলিশিংকে ‘বিট পুলিশিং’ নাম দেওয়া হয়েছিল। আর সেই ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ এর নতুন রুপই হচ্ছে ‘সিটিজেনস্ ফোরাম’।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজের মতে—‘কমিউনিটি পুলিশিং’ এর চেয়েও ‘সিটিজেনস্ ফোরাম’ এর কাজের ব্যপ্তি বেশি। প্রান্তিক পর্যায়ের কমিউনিটি থেকে নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে সেই আগাম তথ্যের ভিত্তিতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়াই এই ফোরামের কাজ।
নগর পুলিশের এই অভিভাবক বলেন, ‘সিটিজেনস্ ফোরাম কমিউনিটি পুলিশিংয়ের আরেকটি রুপ। এর কাজের ব্যপ্তি আরেকটু বড় পরিসরে হবে। কমিউনিটি পুলিশ থেকে এর কাজ একটু বেশি হবে। কমিউনিটি থেকে নানারকম খোঁজ-খবর এবং আগাম তথ্য পাওয়া যায়। এসমস্ত ক্ষেত্রে আগাম ব্যবস্থাও নেওয়া যায়। এই যে কমিউনিটি পুলিশের নতুন করে নাম বলেছি সিটিজেনস্ ফোরাম।'
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকটি থানাতেই এই ফোরামের সদস্যদের বসার এবং মিটিং করার ব্যবস্থা থাকবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে মিলেমিশে তারা এলাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি এবং চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে কি কি করা যায়—সে ব্যাপারে হেডকোয়ার্টার্সে চাহিদা জানাবে।’
সিএমপি কমিশনার জানান, সমাজের প্রান্তিক অংশ যেমন—প্রতিবন্ধী, বয়স্ক মানুষ, দুস্থ নারী, যারা গরীব মানুষ কোথাও সেবা দাবি করতে পারে না এই ফোরামের সদস্যরা তাদের কথাগুলো থানা পুলিশকে অবহিত করবেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
এছাড়াও সদস্যরা যদি নিজেরা যদি নৈশটহল, ট্রাফিকিংয়ে কাজ করাসহ ভলিন্টিয়ারিং এর ব্যবস্থা করতে চান, করতে পারবেন।
নগর পুলিশের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মূলত সমাজের সব স্তরের জণমানুষকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যেই কাজ করবে এই ফোরাম। এরমধ্যে সর্বস্তরের মানুষ পুলিশের কাজে সহযোগিতা, অপরাধবিরোধী সচেতনতা তৈরি, বাল্যবিবাহ রোধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, মাদকের কুফল, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধসহ সামাজিক মূল্যবোধ বাড়াতে কাজ করবেন তারা।
কারা আছেন কমিটিতে?
পুলিশ বলছে, নগরের ১৬ থানার প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মসজিদ ও মাদ্রাসার ইমাম, এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সামাজিক সংগঠক, সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের নিয়ে এই ‘সিটিজেনস্ ফোরাম’ গঠন করা হয়েছে।
গত সরকারের আমলের ‘কমিউনিটি পুলিশিং’-এর মতো বিতর্ক এড়াতে এবার কয়েক ধাপে ভেরিফিকেশন করে সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেটি বলছেন খোদ সিএমপি কমিশনারও।
নাম প্রকাশে অনুচ্ছিক সিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব ফোরাম কিংবা কমিউনিটিতে সমাজের বিভিন্ন অংশীদারদের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। আবার তারা যেন সমাজের স্বচ্ছ ব্যক্তি হয় সেদিকেও নজর রাখা উচিত। কিন্তু গত সরকারের আমলে বিভিন্ন চোর-বাটপার কিংবা সন্ত্রাসীকে কমিউনিটি পুলিশিং এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই এবার সিটিজেনস্ ফোরাম-এ যাচাই-বাছাই করে ক্লিন ইমেজের লোকদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে।’
সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ‘সিটিজেনস্ ফোরাম’-এর চট্টগ্রাম মহানগরে ৮৬ সদস্য, কোতোয়ালী থানার ৪৫, সদরঘাট থানার ৫০, চকবাজার থানার ৫০, বাকলিয়া থানার ৪১, খুলশী থানার ৫৩, বায়েজিদ থানার ৫১, পাঁচলাইশ থানার ৪২, চান্দগাঁও থানার ৩৫, পাহাড়তলী থানার ৩৬, আকবরশাহ্ থানার ৪৫, হালিশহর থানার ৫৮, ডডবলমুরিং থানার ৪৯, বন্দর থানার ৩৭, ইপিজেড থানার ৩৬, পতেঙ্গা থানার ২৯ ও কর্ণফুলী থানার ৩১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে হাসিব আজিজ বলেছেন, ‘এটা সিটিজেনস্ ফোরাম। নামটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটা কিন্তু কোনো পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন না, এটা অরাজনৈতিক। আমরা চেষ্টা করেছি এখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সিভিল সোসাইটি, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, ধর্মের মানুষকে একত্র করে এই কমিটি গঠন করেছি। যেন এই কমিটির মধ্যে দিয়ে জন-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে।’
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সদর দপ্তরে ‘সিটিজেনস্ ফোরাম’-এর উদ্বোধন ঘোষণা পূর্ববর্তী দেওয়া বক্তব্যে কমিশনার হাসিব আজিজ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যতটা সম্ভব একটা অরাজনৈতিক চেহারা এই কমিউনিটিতে থাকার কথা। মনে রাখবেন, এই সিটিজেনস্ কমিটি তৈরি করতে আমরা আইনগতভাবে বাধ্য না। কিন্তু আমাদের পুলিশের সদিচ্ছা থেকে এটি গঠন করেছি। অপ্রীতিকর ঘটনা হলে এই কমিটি আমি ভেঙে দিতে বাধ্য হবো।
আমাদের প্রত্যেককে ধৈর্য এবং সংযম বজায় রাখতে হবে। কারো আপত্তি থাকলে তা হৈ হৈ করে বলার বিষয় নয়। এটি রাজনৈতিক পার্টি নয়।’
‘সিটিজেনস্ ফোরাম’ কতটা কার্যকর
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি—কমিউনিটি পুলিশিং এর মতো এই নতুন উদ্যোগে যেন বিতর্কিতরা ঠাঁই না পায়। তারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় কর্মীরা অপকর্ম ‘হালাল’ করতে এসব কমিটিতে স্থান করে নেয়। আর পুলিশের সাথে সুসম্পর্ক করে প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। এসব বিষয়েও পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।
নগরের ইপিজেড এলাকার ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন শুভ বলেন, ‘শুধু কমিটি করলেই হবে না। আমাদের যেন এই কমিটির মাধ্যমে উপকার হয়—সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। এর আগেও আমরা দেখেছি চাঁদাবাজদেরই চাঁদাবাজি নির্মুল করতে কমিটিতে রাখা হয়েছিল। এটা শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার মতো। নতুন বাংলাদেশে নতুন পুলিশিং চাই আমরা। যেন আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে।’
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, 'কমিশনার স্যারের নির্দেশ অনুযায়ী কয়েক দফা ভেরিফেকেশনের মাধ্যমে কমিটিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তারা স্বচ্ছ এবং ক্লিন ইমেজের। আশা করি জনগণ এবং পুলিশের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে সিটিজেনস্ ফোরাম-এর কমিটি।'
একটি জরিপের হিসেবে, আইনি সহায়তার জন্য থানায় যায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ। বাকিরা অর্থাৎ সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই পুলিশের সংস্পর্শে আসেন না। আর এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে পুলিশি সেবা দিতেই এই ফোরাম গঠন হয়েছে। যেকোনো দরকারে কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে পুলিশি সহায়তা পাওয়াই এই ফোরাম গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
সচেতন সমাজের মতে, ভালো কাজের মাধ্যমে যদি এই উদ্যোগ সফল হয় তবে সমাজে অপরাধের প্রবণতা অনেকাংশেই কমে যাবে। সুস্থ-সুন্দর সমাজ গড়তে এই উদ্যোগের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা।